উনিশ শতকের নবজাগরণ-স্পন্দিত, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনা-নিষিক্ত ১৯৭১-এর জনযুদ্ধে রক্তস্নাত আমাদের এই স্বোপার্জিত বাংলাদেশের প্রিয় বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। ‘শৈলকিরীটিনী, সাগরকুন্তলা, সরিৎমালিনী’ এই চট্টগ্রামের সার্ধশতাব্দ অধিক প্রাচীন বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রাম কলেজ। হিরণ্ময় ঐতিহ্যের আধার এই প্রতিষ্ঠান শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চার আলোকসামান্য দীপাধার হিসেবে এই জনপদের অমিত সম্ভাবনার বহুমাত্রিক বিকাশে সততা পালন করছে উপযুক্ত ধাত্রীর অতন্দ্র ভূমিকা।

চট্টগ্রামের সরকারি রেকর্ড এবং প্রখ্যাত ইংরেজ সিভিলিয়ন উইলিয়াম উইলসন হান্টার সাহেবের A Statistical Account of Bengal নামক গ্রন্থ থেকে জানা যায়-১৮৬৯ সালে চট্টগ্রাম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথম অধ্যক্ষ হিসেবে জে সি বোসের হাত ধরে কলেজটির অগ্রযাত্রা সূচিত হয়েছিল। এই কলেজের প্রাক্তন কৃতী ছাত্রদের মধ্যে রয়েছেন ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় ভারতীয়দের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকারী শ্রী সুবিমল দত্ত, বিজ্ঞানী প্রিয়দারঞ্জন রায়, মাস্টারদা সূর্য সেন, বিপ্লবী পূর্ণেন্দু দস্তিদার, কল্পনা দত্ত, নুর আহম্মদ চেয়ারম্যান, আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, সাহিত্যিক মাহবুবুল আলম, কবি ওহীদুল আলম, অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আহমদ, পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী এ. কে. খান, পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর জাকির হোসেন, পূর্ব পাকিস্তানের মন্ত্রী সাহিত্যিক হাবিবুল বাহার, পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের বিচারপতি ইমাম হোসেন, বিজ্ঞানী আবদুল্লাহ আল মুতী, ড. এনামুল হক, ড. আহমদ শরীফ, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, ভাষাসৈনিক আবদুল্লাহ আল হারুন, বেলাল মোহাম্মদ, নোবেল বিজয়ী ড. মুহম্মদ ইউনূস, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ডা. কামাল এ. খাঁন, নাট্যব্যক্তিত্ব মাহবুব হাসান, বিশিষ্ট চিন্তক ও সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন, প্রফেসর এমোরিটাস আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন(সাবেক উপাচার্য, চবি), প্রখ্যাত রসায়নবিদ প্রফেসর ড. সরোজ কান্তি সিংহ হাজারী, ইতিহাসবিদ প্রফেসর মুনতাসির মামুন, বিশিষ্ট পণ্ডিত ও সমাজবিশ্লেষক সলিমুল্লাহ খান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিসি প্রফেসর ড. শিরীণ আখতার, সাহিত্যিক চৌধুরী জহুরুল হক প্রমুখ।

সাহিত্য ও সংস্কৃতির অপার উৎকর্ষ সাধনের পাশাপাশি বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনার জাগরণেও এ কলেজের ছাত্র-শিক্ষকের ভূমিকা ছিল অনন্য। ১৯৩০ সালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ঐতিহাসিক চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন ও জালালাবাদ যুদ্ধে মাস্টারদা সূর্য সেনের তরুণ সহযোগী এবং ২০১১ সালের স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী ছিলেন চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র। অমর একুশের প্রথম কবিতা-যার অন্তর্মূলে নিহিত ছিল বাঙালির স্বাধীনতার বীজমন্ত্র- ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’-র রচয়িতা মাহবুব উল আলম চৌধুরী ছিলেন এই চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র। কারাগারের বাইরে ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারিতে জে. এম. সেন হল প্রাঙ্গণে মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটকের প্রথম মঞ্চায়নের আয়োজক ও অভিনেতাদের অধিকাংশই ছিলেন এ কলেজের ছাত্র এবং ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ‘কবর’ নাটকের প্রথম কল শো অনুষ্ঠিত হয় চট্টগ্রাম কলেজ মঞ্চেই। বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনের ব্যাপ্তি ও তীব্রতা সঞ্চারেও অসীম সাহসী ভূমিকা পালন করেন এ কলেজের ছাত্ররাই; আইয়ুব খানের সামরিক শাসনকালে পরম অকুতোভয়ে এই কলেজের ছাত্ররাই ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতব্যাপী কলেজ ক্যাম্পাসে প্রথম শহিদ মিনার নির্মাণ করে উদযাপন করে অমর একুশে এবং এই ইতিহাসকে ধারণ করেই চট্টগ্রামের প্রথম স্থায়ী শহিদ মিনারটি নির্মিত হয় চট্টগ্রাম কলেজে।

১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মার্চ চট্টগ্রাম কলেজ-মাঠে উত্তোলিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা এবং বাংলা বিভাগের অধ্যাপক নাট্যকার মমতাজ উদ্দীন আহমদের রচনা ও নির্দেশনায় ছাত্র-শিক্ষকের যৌথ অভিনয়ে এ মাঠেই মঞ্চস্থ হয় ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’। দশ সহস্রাধিক দর্শক এ নাটক দেখে আবেগে উদ্দীপিত হয়ে মিছিল সহকারে ছুটে গিয়েছিল বন্দর অভিমুখে শত্রুর মুখোমুখি দাঁড়াতে। মহান মুক্তিযুদ্ধে শহিদ হয়েছেন কলেজের দর্শন বিভাগের গুণী শিক্ষক অধ্যাপক অবনীমোহন দত্ত, ছাত্রনেতা শাহজাহান মিয়া কবির, মুরিদুল আলম এবং আব্দুর রব প্রমুখ। উল্লেখ্য, ইতিমধ্যে কলেজ অডিটোরিয়ামটির নামকরণ করা হয়েছে শহিদ অবনীমোহন দত্ত অডিটোরিয়াম এবং ছাত্র মিলনায়তনটির নামকরণ করা হয়েছে শহিদ মুক্তিযোদ্ধা মুরিদুল আলম ছাত্র মিলনায়তন।

সার্ধশত বছর অধিক কালের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যস্নাত চট্টগ্রাম কলেজ ইট পাথরের গাঁথুনিতে বহুবর্ণ ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী। চট্টগ্রাম কলেজের আজকের এই নান্দনিক পরিসর ও আবহ বিনির্মাণে, ৫২ থেকে ৭১ ম্যুরাল স্থাপনে, কলেজের ভৌত অবকাঠামো নবরূপায়ণে ব্যাপক অবদান রেখেছেন কলেজটির প্রয়াত প্রাক্তন অধ্যক্ষ বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রফেসর শেখর দস্তিদার। তার নামে কলেজের শিক্ষক মিলনায়তনে নামকরণ করা হয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ শেখর দস্তিদার মিলনায়তন। স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী-তে কলেজে কর্মরত শিক্ষকদের প্রত্যক্ষ অনুদানে নির্মিত হয়েছে জাতির পিতার প্রতিকৃতিযুক্ত ‘স্বাধীনতা স্মারক’।

বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন-এর ভিডিও চিত্র